Thursday , March 16 2023

ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূরীকরণ পদ্ধতি

ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূরীকরণ পদ্ধতি: ফসলের রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে ফসলকে রক্ষা করার জন্য এবং কাংখিত মাত্রায় উৎপাদনকে ধরে রাখার জন্য কৃষকরা প্রতিনিয়তই আগাছা নাশক ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে । এ সমস্ত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশে এবং জনস্থাস্থ্যে নানারপ বিরপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে । ফসলে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের পর বালাইনাশকের অপেক্ষমান সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে তার পূর্বেই ফসল সংখহ করলে ফসলে বিষাক্ত রাসায়নিক বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যেতে পারে ।

এ সমস্ত রাসায়নিক বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশ ফসলে কি পরিমাণ বিদ্যমান থাকে তাহা নির্ভর করে ফসলে প্রয়োগকৃত বালাইনাশকের ধরণ, প্রয়োগকৃত বালাইনাশকের মাত্রা, প্রয়োগকৃত ফসলের বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন প্রকার পরিবেশগত উপাদান যেমন- তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, বায়ু প্রবাহ ইত্যাদির উপর |

বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা

কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বালাইনাশক বিশ্রেষণ গবেষণাগারের প্রাপ্ত ফলাফল হতে প্রতিয়মান হয় যে, বাজার হতে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রকার সবজির নমুনা সমুহের মধ্যে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ নমুনাতে বিভিন্ন প্রকার বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশ বিদ্যমান । এদের মধ্যে শতকরা ১০-১২ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে ছিল । তবে বাজারজাতকৃত বিভিন্ন প্রকার ফলের (আম, লিচু, পেয়ারা, বড়ই ইত্যাদি) নমুনাতে প্রাপ্ত বালাই নাশকের অবশিষ্ঠাংশের পরিমাণ শাকসবজিতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশের পরিমাণের চেয়ে অনেক কম ।

বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগার, কীটতন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন হতে প্রতিয়মান হয় যে, বিশ্লেষণকৃত বিভিন্ন প্রকার ফলের নমুনা সমূহের মধ্যে শতকরা ৮-১০ ভাগ নমুনাতে বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশ বিদ্যমান । এদের মধ্যে মাত্র শতকরা ৩-৪ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে ছিল ।

যদিও এর উপরে রয়েছে এমন ফল-মূল (শতকরা ৩-৪ ভাগ) ও শাকসবজির (শতকরা ১০-১২ ভাগ) নমুনার সংখ্যা তুলনামুলকভাবে কম, তথাপিও এ সম্ভাবনা থেকেই যায় যে, আমরা যে সমস্ত ফল-মূল বা শাকসবজি বাজার থেকে ক্রয় করে ভক্ষন করছি হতে পারে সে সমস্ত ফল-মূল ও শাকসবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশের পরিমাণ সবেচ্চি সহনীয় মাত্রার উপরে । কাজেই আমাদের জন্য প্রয়োজন বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশ কিভাবে ফল-মূল এবং শাকসবজি হতে হ্রাস করা যায় তা অনুসরণ করা ।

শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূরীকরণ

ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূরীকরণ পদ্ধতি ফল-মূল, শাকসবজি ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণরূপে দূর করা সম্ভব নয় । তবে, কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে ফল-মূল, শাকসবজি ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য হতে সহজেই বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ (শতকরা ৬০-৮০ ভাগ) দূর করা যায় ।

যে সমস্ত পদ্ধতির মাধ্যমে ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায় সেগুলো হলো:

ক) ফল-মূল ও শাকসবজি ধৌতকরণ
খ) ফল-মূল ও সবজির খোসা ছাড়ানো
গ) শাকসবজি রান্না করা
ঘ) ফল-মূল ও শাকসবজি বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রবনে ডুবিয়ে রাখা

ক) ফল-মূল ও শীকসবজি ধৌতকরণ

ফল-মূল, শাকসবজি ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য চলমান অথবা স্থায়ী পানি দ্বারা ধৌত করার মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দুর করা যায়। ধৌতকরণ পদ্ধতির কার্ষকারীতা নির্ভর করে ব্যবহৃত বালাইনাশকের ফিজিওকেমিক্যাল বৈশিষ্ট্যের উপর । যেমন: পানিতে বালাইনাশকের দ্রবনীয়তা, ফল ও সবজি ইত্যাদিতে বালাইনাশকের প্রকৃত অবস্থান । ধৌতকরণের জন্য ব্যবহত পানির তাপমাত্রাও বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূরীকরণে প্রভাব ফেলে । গবেষণায় দেখা যায় যে, গরম পানিতে ধৌত করলে ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ ঠান্ডা পানির দ্বারা

ধৌত করার চেয়ে বেশী দূর করা যায় । ধৌত করার সময় যদি ১ মিনিট হাত দ্বারা ভালভাবে ফল-মূল, শাকসবজি পরিস্কার করা হয় তবে এ পদ্ধতির কার্ষকারীতা আরো বৃদ্ধি পায়। এখানে উল্লেখ্য যে, যৌতকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে অন্তর্বাহী বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উল্লেখযোগ্যভাবে দূর করা যায় না, তবে স্পর্শ ও পাকস্থলী বালাইনাশকের অবশিষ্ঠাংশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হাস পায় ।

খ) ফল-মূল ও সবজির খোসা ছাড়ানো

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন হতে দেখা যায় যে, সাধারণত: সবজির বাহিরের পাতা এবং ফল-মূল ইত্যাদির বাহিরের আবরনে বেশি বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উপস্থিত থাকে। কাজেই যদি ফল-মূল এবং সবজির বাহিরের আবরনটি দুর করা হয় তবে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উল্লেখযোগ্যভাবে হাস পায় । এক গবেষণা প্রতিবেদন হতে দেখা যায় যে, খোসা ছাড়ানোর মাধ্যমে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায় ।

এ পদ্ধতিটি বেশী কার্যকর যে সমস্ত ফল ও সবজি খোসা ছাড়া ভক্ষণ করা হয় যেমন: শসা, কলা, পেঁপে, আম এবং লেবু জাতীয় ফল ইত্যাদি ।

গ) শাকসবজি রান্না করা

সাধারণত: রান্না করার মাধ্যমে শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দুর করা যায়। এ পদ্ধতির কার্যকারীতা নির্ভর করে রান্নার সময়কাল, তাপমাত্রার পরিমাণ, খাদ্য দ্রব্যে পানি সংযোজনের পরিমাণ এবং রান্নার ধরণ (খোলা বা বন্ধ) ইত্যাদির উপর | সাধারণত: খোলা পদ্ধতিতে বাম্পীভবন এবং বন্ধ পদ্ধতিতে পানির সাথে রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে বিয়োজনের মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ হাস পায় ।

ঘ) ফল-মূল ও শাকসবজি বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রবনে ডুবিয়ে রাখা

১) লবণ পানির মিশ্রণে ডুবিয়ে রাখা:

সাধারণত: ফল-মূল, শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন হতে এটা প্রমাণিত যে, লবণ-পানির মিশ্রণে ফল-মূল, শাকসবজি ডুবিয়ে রাখলে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হাস পায় ।

কীটতন্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন হতে প্রতিয়মান হয় যে, ১ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম বা ২ চা চামচ খাবার লবণ (২% লবণ-পানির দ্রবন) মিশিয়ে ১৫ মিনিট পর্যন্ত ফল-মূল, শাকসবজি ডুবিয়ে রাখলে বালাইনাশকের ক্রিয়ার ধরনের উপর ভিত্তি করে শতকরা ৩০-৮০ ভাগ পর্যন্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায় ।

২) ভিনেগার পানির মিশ্রণে ডুবিয়ে রাখা:

ফল মূল ও শাকসবজি ভিনেগার ও পানির মিশ্রণে ডুবিয়ে রাখার মাধ্যমে ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমান কমিয়ে আনা যায় । এ ক্ষেত্রে প্রথমে ৫% ভিনেগার দ্রবন তৈরী করতে হবে। এ জন্য ১ লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার সাদা ভিনেগার ঢেলে মিশিয়ে নিতে হবে । তারপর কাংখিত ফল-মূল ও শাকসবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে । অত:পর পরিস্কার পানিতে ধুয়ে নিলে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ ৪০-৮০ ভাগত্থাস পায় ।

ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূরীকরণের সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি

ফল-মূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূরীকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলো উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। এ সমস্ত পদ্ধতি সমূহের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী একটি পদ্ধতি কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগার হতে উদ্ভাবন করা হয়েছে যা সহজে এবং নিরাপদভাবে সকলের জন্যই ব্যবহারযোগ্য, সাশ্রয়ী ও অত্যন্ত কার্যকরী | এ পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা নিরাপদ খাদ্য (ফল-মূল, শাকসবজি) গ্রহণ করতে পারব যা আমাদেরকে রাসায়নিক বালাইনাশকের বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে গুরুত্পূর্ণ ভূমিকা রাখবে ।

উক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করে ফল-মূল এবং শাকসবজি হতে শতকরা ৬০-৮০ ভাগ বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *